সালাম : ইসলামের অনুপম অভিবাদন পদ্ধতি-১

Daily Inqilab মাওলানা আবু তাহের রাহমানী

৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৪ এএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৪ এএম

পৃথিবীর সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা বিনিময়ে, কল্যাণ কামনা এবং অন্তরঙ্গতা প্রদর্শনে অভিবাদনের বিশেষ পরিভাষা প্রচলিত রয়েছে। ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবদের মধ্যেও পারস্পরিক সাক্ষাতকালে একজন অপরজনকে অভিবাদন জানানোর বিশেষ পরিভাষা প্রচলিত ছিল। ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) বলেন, ইসলাম-পূর্ব কালে আমরা পারস্পরিক সাক্ষাতের সময় বলতাম : ‘আনআ’মাল্লাহু বিকা আ’ইনান’ (আল্লাহ তোমার চোখ শীতল করুন)। ‘আনই’ম সাবাহান’ (তোমার প্রভাত শুভ হোক)।

যখন আমরা জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত হলাম, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে অভিবাদনের পূর্ববর্তী পরিভাষা রহিত করে পারস্পরিক সাক্ষাতকালে ‘আসসালামু আলাইকুম’ (তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক)Ñ এ শিক্ষা দান করলেন। (দ্র. সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৫২২৭)। একজন মুসলিমের আরেক মুসলিমের ওপর যতো হক রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হক হলো, একজন আরেকজনকে সালাম দেয়া।

সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, একজন মুসলিমের ওপর অপর মুসলিমের ছয়টি বিশেষ হক রয়েছে : ১. সাক্ষাৎ হলে, তুমি তাকে সালাম দেবে। ২. তোমাকে দাওয়াত দিলে, (শরয়ী কোনো ওযর না থাকলে) তার দাওয়াত গ্রহণ করবে। ৩. তোমার নিকট উপদেশ (বা নিঃস্বার্থ পরামর্শ) কামনা করলে তাকে (নিঃস্বার্থভাবে) উপদেশ বা পরামর্শ দেবে। ৪. হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বললে জবাবে তুমি ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ (আল্লাহ তোমার প্রতি রহম করুন) বলবে। ৫. অসুস্থ হলে তুমি তার শুশ্রূষা করবে। ৬. মৃত্যুবরণ করলে তুমি তার জানাযা (দাফনে) শরীক হবে। (সহীহ মুসলিম : ২১৬২)।

বস্তুত, পারস্পরিক হৃদ্যতা-অন্তরঙ্গতা, সুসম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য সৃষ্টিতে এবং একে অপরের কল্যাণকামিতা প্রদর্শনে সালাম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট কোনো বিষয় পৃথিবীর কোনো জাতিগোষ্ঠী পেশ করতে পারেনি। মুসলমানদের পারস্পরিক সাক্ষাতে সালাম বিনিময় হলো শ্রেষ্ঠতম অভিবাদন পদ্ধতি। ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর অর্থ, তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আসসালাম অর্থ শান্তিÑ ইহজাগতিক ও পরজাগতিক উভয় প্রকার শান্তি এখানে উদ্দেশ্য। কারণ, শব্দটি নিঃশর্তভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

সুতরাং একজন মুমিন অপর মুমিনকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলার অর্থ হলো, একজন অপরজনের ইহকালীন ও পরকালীন সব ধরনের শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করছে। অধিকন্তু সালাম প্রদানকারী ও সালামের জবাব দানকারী প্রত্যেকে নিজের পক্ষ থেকে অপরজনের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করছে। সালাম প্রদানের মাধ্যমে যেহেতু আরেক মুসলিম ভাইকে শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হয়, তাই অন্যের গৃহে প্রবেশ করার পূর্বে গৃহবাসীকে সালাম প্রদানের বিধান দেয়া হয়েছে।

নিজ গৃহ ব্যতিরেকে অন্য কারো গৃহে প্রবেশ করার নীতি নির্দেশ করে কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে : হে মুমিনগণ! তোমরা অন্যের গৃহে গৃহবাসীর অনুমতি না নিয়ে এবং তাদেরকে সালাম না দিয়ে প্রবেশ করো না। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। (সূরা নূর : ২৭)। পারস্পরিক সাক্ষাতকালে এক মুসলমান অপর মুসলমানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলা প্রকারান্তরে অপর মুসলমানের জন্য অত্যন্ত সুসমৃদ্ধ ও সারগর্ভ দুআ করা এবং তার ইহ ও পরজাগতিক সব ধরনের শান্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণ কামনা করা।

এটা বড়দের পক্ষ থেকে ছোটদের প্রতি পরম স্নেহ ও মায়া মমতা প্রদর্শনের মাধ্যম। অনুরূপ ছোটদের পক্ষ থেকে বড়দের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনেরও মাধ্যম। ‘সালাম’ এটি আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নামসমূহের মধ্য থেকে একটি। সূরা হাশরে ইরশাদ হয়েছে : তিনি বাদশাহ, পবিত্রতার অধিকারী, শান্তিদাতা ...। (সূরা হাশর : ২৩)। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে ‘সালাম’ শব্দটি নবী-রাসূলগণের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রকাশার্থে ব্যবহার করেছেন। দেখা যেতে পারে সূরা ইয়াসিনের ৫৮ নং আয়াত, সূরা সাফফাতের ৭৯, ১০৯ ১৮১ নং আয়াত।

মহানবী (সা.) নির্দেশিত সালামের এ শাশ্বত বিধান মুসলমানদের সামাজিক জীবনে পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস, শান্তি-নিরাপত্তা, প্রেম-ভালবাসা এবং ঘনিষ্ঠতা ও অন্তরঙ্গতা সৃষ্টিতে এক অব্যর্থ মাধ্যম। পূর্ব পরিচিত দুই ঘনিষ্ঠজনের মাঝে যখন সালাম বিনিময় অব্যাহত থাকে, এর মাধ্যমে পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সৌভ্রাতৃত্ব, মহব্বত-ভালবাসা এবং একে অপরের শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা পূর্বাপেক্ষা বহু বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। অপরিচিত দুইজনের মাঝে সালাম আদান-প্রদান অব্যাহত থাকলে, পরস্পরের মধ্যে আস্থা-বিশ্বাস, অন্তরঙ্গতা ও হিতকামনার মানসিকতা সৃষ্টি হয়। মুসলমানদের জীবনে সালাম বিনিময় যেমন মহানবী (সা.) নির্দেশিত ও প্রবর্তিত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও কল্যাণজনক শিক্ষা, তেমনি তা ইসলামের একটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক ও সর্বজনীন নিদর্শনও বটে।


বিভাগ : শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

রাজবাড়ীতে ভোট চেয়ে বাড়ী ফেরার পথে একজনকে কুপিয়ে জখম

রাজবাড়ীতে ভোট চেয়ে বাড়ী ফেরার পথে একজনকে কুপিয়ে জখম

৫ দিনের ছুটির কবলে বেনাপোল স্থলবন্দর

৫ দিনের ছুটির কবলে বেনাপোল স্থলবন্দর

গোদাগাড়ীতে কৃষি মন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সোহেল

গোদাগাড়ীতে কৃষি মন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সোহেল

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী তৎপরতার তথ্য পেলেই অভিযান : র‌্যাব পরিচালক

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী তৎপরতার তথ্য পেলেই অভিযান : র‌্যাব পরিচালক

যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল

যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল

প্রস্তুতি ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত

প্রস্তুতি ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত

ফ্রান্সে ইহুদি উপাসনালয়ে আগুন, অভিযুক্তকে গুলি করে হত্যা

ফ্রান্সে ইহুদি উপাসনালয়ে আগুন, অভিযুক্তকে গুলি করে হত্যা

নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে

নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে

বেলজিয়াম-নেদারল্যান্ডস-জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজক ব্রাজিল

বেলজিয়াম-নেদারল্যান্ডস-জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজক ব্রাজিল

নদী ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘূম রাত কাটে উপকূলবাসীর

নদী ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘূম রাত কাটে উপকূলবাসীর

দিঘিতে মিলল এক মণ ওজনের কোরাল, বিক্রি ৪০ হাজারে

দিঘিতে মিলল এক মণ ওজনের কোরাল, বিক্রি ৪০ হাজারে

সুধা রানীর হাদিসের প্রভাষক পদে উত্তীর্ণ হওয়া নিয়ে তোলপাড়, যে ব্যাখ্যা এনটিআরসির

সুধা রানীর হাদিসের প্রভাষক পদে উত্তীর্ণ হওয়া নিয়ে তোলপাড়, যে ব্যাখ্যা এনটিআরসির

গাজায় ইসরায়েলের অভিযান বন্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশ চেয়েছে দ. আফ্রিকা

গাজায় ইসরায়েলের অভিযান বন্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশ চেয়েছে দ. আফ্রিকা

১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাবে যুক্তরাজ্য

১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাবে যুক্তরাজ্য

দৌলতপুরে পদ্মায় নিখোঁজ কিশোরের লাশ উদ্ধার

দৌলতপুরে পদ্মায় নিখোঁজ কিশোরের লাশ উদ্ধার

কলকাতায় ফের করোনা আতঙ্ক, এক সপ্তাহে আক্রান্ত ৫

কলকাতায় ফের করোনা আতঙ্ক, এক সপ্তাহে আক্রান্ত ৫

মুখোমুখি বিতর্কে রাজি বাইডেন ও ট্রাম্প, কবে হবে জোড়া বাকযুদ্ধ?

মুখোমুখি বিতর্কে রাজি বাইডেন ও ট্রাম্প, কবে হবে জোড়া বাকযুদ্ধ?

তিন দশকের মধ্যে গড় আয়ু পাঁচ বছর বাড়বে

তিন দশকের মধ্যে গড় আয়ু পাঁচ বছর বাড়বে

জার্মানিতে বিস্ফোরণের পরে বাড়িতে আগুন, নিহত তিন

জার্মানিতে বিস্ফোরণের পরে বাড়িতে আগুন, নিহত তিন

ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যা মামলার শুনানি শুরু

ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যা মামলার শুনানি শুরু